জবাব

কাউসার আলম

তখন সদ্য অনার্স পাশ করেছি। একটা স্কুলে পার্ট টাইম পড়াই। সারাদিন স্কুলের বাচ্চাদের সাথে থাকি, ভালোই লাগে! বাসা থেকে স্কুলের দূরত্বও বেশি না। সিএনজিতে ২০ মিনিট মাত্র!  আমি যে রাস্তা দিয়ে যাই, সে রাস্তা দিয়ে একটা মেয়েও কলেজে যায় সিএনজিতে। একটা কেন হাজার হাজার মেয়ে যায়, ছেলে যায়, বৃদ্ধ যায়, বৃদ্ধা যায়। তবে আলাদা ভাবে ওর কথা বলার কারণ হলো, আমরা প্রায় একই টাইমে যাই। তাই প্রায়ই একই সিএনজিতে যাওয়া হয়।

"প্রথম দেখায় ভালোবাসা" টাইপের সস্তা কথায় আমি বিশ্বাস করি না কখনও। তবে প্রথম দেখায় তাকে "অন্যরকম" লেগেছিলো, সেটা অস্বীকার করতে পারবো না। আসলে সেটাই ছিল "শেষ দেখা"! কারণ এরপর থেকে সরাসরি তার মুখের দিকে কখনোই তাকাই নি কিংবা তাকাতে পারি নি। অজানা সংকোচ এসে ভর করতো!

 মেয়েটি একটি কলেজে পড়ে। আপাদমস্তক বোরখাপরিহিতা, তবে মুখটা খোলা থাকে! আমার প্রায় ৫ মিনিট আগেই তাকে নেমে পড়তে হয়, তার কলেজগেটে। কদিন পর আবিষ্কার করলাম সে সিএনজির দুই সিট ভাড়া নেয়! তার এই সিট বিলাসিতা আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগলো। অজানা কারণে খুশি হলাম! আমাদের ভার্সিটির বাসে তো ছেলেমেয়ে এমন গাদাগাদি করে যেতে হতো, মাঝে মাঝে মনে হত একজন আরেকজনের কোলে বসে যাতায়াত করছি। সেই একটা যুগ ছিল, যখন মেয়েরা রিকশায় ওঠলে কাপড় দিয়ে রিকশা মুড়িয়ে দেওয়া হতো! আর এখন তো অনেক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরাও পুরুষদের সাথে গায়ে গা লাগিয়ে যাতায়াত করে!

 প্রায় চার মাস কাটলো। খুব কম দিনই আমরা ভিন্ন সিএনজিতে যাতায়াত করেছি। একসাথে যাতায়াত করতে করতে বলতে গেলে ইতোমধ্যে আমাদের মধ্যে এক অদৃশ্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সে কী ফিল করে জানি না, তবে আমি তা-ই ফিল করতাম। সাহিত্যিক হলে হয়ত এ সম্পর্কের একটা নাম দিতে পারতাম! কৌতুহল হতো, সেও কী আমার মতো করে ভাবে?

 ব্যাগ থেকে ফোন বের করে সে তার মায়ের সাথে কথা বলল, সিলেটি ভাষায়। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো হবে। এই প্রথম কণ্ঠ শুনলাম। "খুব চমৎকার" "আকর্ষণীয়" "একবার শুনলে আরেকবার শুনতে মন চায়" সাহিত্যিকদের মতো এসব অতিরঞ্জিত উপমা আমি দিবো না। তবে কণ্ঠে ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল প্রবল। যেন এ কণ্ঠের উপর ভরসা করা যায়। এ কণ্ঠই কি এতদিন খুঁজছিলাম? আরেকটা ব্যাপার দাগ কাটলো। এ বয়সের মেয়েরা সাধারণত সারাক্ষণই এন্ড্রয়েড চাপতে থাকতে। অথচ এতদিনে একবারের জন্যেও তাকে মোবাইল হাতে নিতে দেখি নি।

 স্কুলে আমার মন বসে না। নিজেকে টিনেজ মনে হয়। বুঝতে পারছিলাম না, আমার কী হয়েছে! রাস্তায় সিএনজি অপেক্ষা করার সময়টুকুইই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমার সবচেয়ে আনন্দদায়ক সময়! হাত দিয়ে সিএনজি থামাই। যদি দেখি ও নেই, ওঠি না। ওরটার জন্যে অপেক্ষা করি। এমনও হয়েছে, অপেক্ষা করতে করতে আমার স্কুলের সময় পেরিয়ে গেছে, ও সেদিন আর কলেজে আসেই নি। যেদিন ওর সিএনজির সিট ফাঁকা না থাকে, অন্য সিএনজিতে স্কুলে যাই। ২০ মিনিটকে ২০০ মিনিট মনে হয়।

 নাহ, আর পারি না। ওর সাথে কথা বলবো। বলতেই হবে! কী বলবো! "আপনার বাসা কোথায়?" "আপনার নাম কী?" অন্তত একটা কিছু বলতেই হবে!

রাস্তাটা ছিল ব্যস্ততম রাস্তা, বড় বড় গাড়ি যাতায়াত করে। প্রায়ই ব্রেক ধরতে হয়! হঠাৎ ব্রেক ধরায় সিএনজির সামনের লোহায় ধাক্কা খেয়ে সে যেদিন কপালে হালকা আঘাত পেল, সেদিন আমি আরও নতুন কিছু আবিষ্কার করলাম। আমার খুব কষ্ট হলো, খুব। বলাবাহুল্য, আমিও হালকা আঘাত পেয়েছি। কিন্তু সেটা আমার মনেই হলো না। নিজের ফ্যামিলির বাইরের কারও জন্যেও যে এতটা ফিলিংস হতে পারে এই প্রথম অনুভব করলাম!

 এবার আমি আরও উতলা হয়ে পড়লাম। একবার কথা বলেই দেখি না! নিজেকে স্থির করলাম। টিনেজারদের মতো পাগলামি করলে চলবে না। ধীরেসুস্থে চিন্তা করতে হবে। যদি নাম জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দেয়, আমি সহ্য করতে পারবো না! কথার জবাব না দেওয়ার চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে! আমি লজ্জায় অপমানে শেষ হয়ে যাবো। অনেক ভেবে ঠিক করলাম, এমন একটা কিছু বলতে হবে, যার জবাব না পেলেও চলবে। সে যখন তার কলেজগেটে নামবে তখন বলব, "গাড়ি দেখে সাবধানে নামবেন!" সে যদি এর জবাব না-ও দেয়, সমস্যা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, "থ্যাংক ইউ" বলবে!

সেটা ছিল, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় রাত। আয়নার সামনে বারবার ওই চারটি শব্দ আওড়াচ্ছিলাম! একবার ভাবলাম, পরামর্শ চেয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেই! আবার মনে হলো, কিছু অনুভূতি শুধু নিজের, একান্তই নিজের। পাবলিক প্লেসে শেয়ার করলে সেগুলো সস্তা হয়ে যায়!

 সিএনজিতে বসে কাঁপছিলাম। লজ্জা ভয় মিশে একাকার। নিশ্চয়ই থ্যাংক ইউ বলবে। হাসবে কী? হাসিটা কেমন হবে? আজ ১৫ মিনিট যেন শেষই হচ্ছে না। বলাবাহুল্য, এভাবে কিছুক্ষণ থাকলে আমার হার্ট ফেল করবে! কাঙ্ক্ষিত সময় এলো। কলেজগেটে সিএনজি থামলো! সে নামছিলো। "সাবধানে গাড়ি........." গলা থেকে আওয়াজ বেরুচ্ছিলো না আমার। আর বলতে পারলাম না। বলার প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেছে। একটা ট্রাক দ্রুতগতিতে ওকে ঘেঁষে চলে গেলো! কয়েক ফোঁটা রক্ত আমার শরীরেও এসে ছিটে পড়লো! নাহ, আর কোনোদিন সে জবাব দিতে পারবে না। ....পুরো পৃথিবীই জনমানবশূন্য এন্টার্কটিকা!

 

kaosar Alam

কাউসার আলম

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক।

সম্পাদক: আবু মুস্তাফিজ

৩/১৯, ব্লক-বি, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা