প্রলেপন
নেসার ভাইকে....
বিভাবন ক্রিয়াকর্মে প্রলেপ দিয়ে দিনাতিপাত
রুধির প্রোজ্জ্বল আলোক-শক্তিকে করে নিঃশেষ;
কে যেন কাঁপিয়ে যায়—যেন অস্থির জলপ্রপাত;
স্নিগ্ধ কোনো ভাবনা নয়, স্বতন্ত্র মৃত্যুর কোশেশ।
এ কোন কীটাণুকীট? এভাবে নিসূদকী কামড়
দিয়ে করে রক্তশূন্য, ফ্যাকাশ, বিবশিত, ধবল
এ কোন জীবাণুজীব? দংশনে অসহ কাতর?
নীরবে বৃশ্চিক সই, প্রঘাতে প্রহত বিহ্বল।
প্রাতিস্বিক সারল্যে ভাবছিলাম কাটবে জীবন,
অথচ গরল আর মৃণালে ভরা বিকারগ্রস্ত
প্রতিসর আঁধারে জারি হয়েছে মৃত্যুর সমন;
সহস্র ময়াল খেলছে, যেন এ গ্রোটেস্ক মনস্তত্ত্ব।
দেহজ দোজখে কোন অচেনা এ চিন্তা ও চিন্তক?
উদ্বাহু আমি, ধরো, হে মহা মৌনী অরূপ একক!
--------------------------------------------------------------------------------------------------------
মুহাম্মাদ আপনাকে
হে মুহাম্মাদ! আমি যে বিরাট কাজ্জাব হয়ে যাচ্ছি; আমি আমার ভেতর নাফাকির সমস্ত আলামত দেখতে পাচ্ছি।
হে মুহাম্মাদ! আমি বুঝতে পারছি, আমি চিনতে পারছি মনুষ্য-মুখোশ।
হে মুহাম্মাদ! আমি যে পাপে ঢুকেই যাচ্ছি, ডুবেই যাচ্ছি, আমাকে উদ্ধারের কোনো পথ আমি পাচ্ছি না যে!
হে মুহাম্মাদ! আপনার দুরুদ আমার সঙ্গী, আপনার হাদিস আমি চাখি, মাধুরী-চরিত্র আমি পড়ি, আমি মুক্তি পাই না, আমি নাজাত পাই না।
হে মুহাম্মাদ! আমার সামনে আঁধারের মুকুর মুকুর আর মুকুর। আমি অন্তর্জ্বলনে দগ্ধ, অন্তর্পীড়নগ্রস্ত, অন্তর্গ্রাস আমার খেয়ে ফেলেছে সবটুকু।
হে মুহাম্মাদ! আমি কী যে দারুণ পীড়িত, রুগ্ণ, আমি কী করে আপনাকে বলি? হাসান সাবেতের কলম তো আমাকে দেয়া হয়নি, ফারুকের জিহ্বা তো আমার নেই।
হে মুহাম্মাদ! আমি তো ডুবে আছি অবিশ্বাসীদের অক্ষরে-হরফে, কী করবো বলুন, মুহাম্মাদ? আমার জাতি যে ক্রম পিছু অগ্রসরমান। যখন মুয়াজ আর মুয়াওয়াজ কেটে নিয়েছিলেন আবু জেহেলের গলা, সাহাবি রাফে যখন পায়ের পাতার উপর উঁচু হয়ে জিহাদ-জিহাদ বলেছেন, হাজ্জাজের ভাতিজা মুহাম্মাদ বিজয় করেছেন সিন্ধু, আমি তখন বোদলেয়ার আওড়াই; আমার প্রিয় পরিজন বলে কেউ নেই।
হে মুহাম্মাদ! আপনার সুশীতল হাত নেই, আইনুন নাদীম নেই, পূর্ণিমার মতো তাবাসসুম চৌদ্দশো বছর আগেই সমাহিত হয়েছে সবুজ গম্বুজতলে, নষ্টমুখীদের জায়গা দেওয়ার মতো কেউ নেই তো, প্রিয় মুহাম্মাদ।
হে মুহাম্মাদ! হানজালার যেমন নিজেকে মুনাফিক মনে হতো, আমি তো সর্বক্ষণ নিজেকে মুনাফিক ভাবি তেমন। আমার নামাজে নেই খুশু-খুজু, ইবাদাতে নেই আগ্রহ, শোয়া-বসায় নেই প্রভুর স্মরণ।
মুহাম্মাদ! আমি তো মুনাফিক হয়ে গেছি, মুনাফিক হয়ে গেছি বলে ঝরঝর করে কাঁদতে থাকি বাবার নিভৃত-নির্জন কবরে দাঁড়িয়ে, রাস্তায়, শ্রেণিতে, নগ্ন দয়িতার সামনে।
হে মুহাম্মাদ! আমার আচরণ মহাপঙ্কী হয়ে গেছে, আমার দেহে দেখা দিয়েছে ফাঙ্গাস, অথচ আমার গালে-মুখে সাদী বর্ণিত বাগানের মখমলমতো বাগানের সফেন ঘাস ।
হে মুহাম্মাদ! আমি পীড়িত, আমার জ্বলে যাচ্ছে পুরো দেহ, আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি, আমি দপ করে নিভে যাই, আমি জ্বলে উঠি, কিন্তু মরজিয়্যাত থেকে আমার মুক্তি আসে না।
হে মুহাম্মাদ! আমি কবিতা লিখি, যৌবনে ঢুকি-ঢুকি এ সময়ে আমি ঘুরি বিশ্বসাহিত্যের জানলায়, বাতাসে। আমি শব্দকে পাই বিধর্মী পাজের কথায়, রক্তের আগে, চিন্তারও আগে।
হে মুহাম্মাদ! আপনি তো জানতেন না আপনার প্রভুর কাছ থেকে কোনো পয়গাম নিয়ে আসবেন প্রিয় দূত জিবরিল, সে কথা যখন আমি শুনি স্বর্গীয় যূথভ্রষ্ট কোনো মানুষের মুখে, কী করে আমি তাকে অগ্রাহ্য করি? যখন ওপথে গম্যমান কবিরা দিতে পারেন না কোনো সন্তোষ-বাণী।
হে মুহাম্মাদ! আপনার তো শাক্কে সদর হয়েছিলো, জমজমবিধৌত ছিলো আপনার কলব, আপনাকে বানানো হয়েছিলো, যাতে আপনি আপনি হোন। আপনার মতো সুষম কোনো মনুষ্য-অস্তিত্ব এ জগত দেখেনি, সংসার দেখেনি কোনো এমন অবিশ্বাস্য বিশ্বাসী পুরুষ । তাই তো কোনো দল ভ্রান্ত হয়ে বলে আপনার সৃষ্টি প্রভুর আলো-সরোবর থেকে।
হে মুহাম্মাদ! আপনি বুঝতেন হৃদয়ের অন্ধকারের কথা, আপনি কাঁদতেন মাটিচাপা কুসুমকন্যাদের কথা মনে করে, আপনি রক্ত ঝরিয়েছেন উহুদে-তায়েফে, আপনার ছিলো না কোনো অভিযোগ মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, প্রভুর প্রতি তো আপনি ছিলেন—প্রভুর মুখে, তাঁর হাবীব।
হে মুহাম্মাদ! আপনার খলিফারা ছিলেন আল্লাহর খলিফা, আপনার তাবেঈরা ছিলেন আল্লাহর তাবেঈ, আর যারা দার্শনিক—যেমন গাজ্জালি, আর যারা কবি—যেমন তাইমিয়া : এরা মানুষের প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা খণ্ডন করতে-করতে চঞ্চল থেকেছেন কোনো এক অসাধারণ্যে ।
আমি জানি, হে মুহাম্মাদ! আমার মতো না থেকেও তাঁরা আমার মতোই ছিলেন । ছিলেন অস্থিতি আর অস্থিরতার ঝঞ্ঝিয় ফ্ল্যাগ। এরা ক্রমাগত লাফিয়েছেন, আটকে গেছেন, আবার চিৎকার করেছেন, নীরব হয়ে গেছেন। এদের কারো কেটে নেয়া হয়েছে জিভ আর কারো আরো অগ্রসর হয়ে আলজিভও।
হে মুহাম্মাদ! আমি তো তাদের তুল্য না, ওই মাপকাঠিতে তো আমাকে মাপা যায় না; আমার ভাষা একটাই, আমার অক্ষর অক্ষমতা শুধু এক ভাষাতেই; আমার দৌড়ঝাঁপ-আর্তনাদ সীমাবদ্ধ পরিসীমাতেই ।
হে মুহাম্মাদ! আমি যখন আহমদ রেফায়ির কথা শুনি, তাঁর কবিতা পড়ি, ঈর্ষায় জ্বলে যাই সর্বাঙ্গে, আমি শুধু আপনার কালো পোশাক দেখেছি, তাও স্বপ্নে।
হে মুহাম্মাদ! আমার নিতান্ত জ্ঞান-স্বল্পতায় যখন আমি আপনার আনীত গ্রন্থে আল্লাহ ও তাঁর পরিপার্শ্বের শব্দগুলোর অর্থানুধাবন করি, আমার দু চোখ থেকে বেরিয়ে আসে আবেগাশ্রু; আর আপনার নাস-স্মরণে, দুরুদ-পঠনে এক সবুজ গম্বুজের নিচের জ্বলনে আমার চামড়া পুড়ে-পুড়ে যায়, দেহের ক্ষত থেকে ঝরে পড়তে থাকে অসহ্য পুঁজের গলন।
হে মুহাম্মাদ! আমি কবি, মিথ্যুক ও পাপী ।
হে মুহাম্মাদ! আমি মুখোশধারী, হিপোক্রেট, জায়গাবিশেষে ফিরোশাস, কামাসক্ত। আপনাকে আমার কী বলার থাকতে পারে?
হে মুহাম্মাদ! আমার ভিতর-জ্বলন, আমার কষ্টকান্না; আমার আশৈশব, আকৈশোর দারিদ্র, প্রেম, পিতৃমৃত্যু; আমার মুনাফিক সময়ের প্রতি কোনো শব্দীয়, কোনো কথ্যিয়—দৈহিক, জৈবিক, আত্মিক— জমজমের শীতলতার মতো, যা ইসমাইলের মিষ্টি পদাঘাতে উৎপন্ন—কোনো শীতলতা যদি আমাকে খানিকের জন্য মানসিক স্বস্ততায় থাকতে দিতো!
হে মুহাম্মাদ! তাহলে, তাহলে আমার এইসব দুরপনেয় অসহ্যের কালিমা কি মিথ্যা? আমার অন্তরাঘাত কি প্রভুর দরবারে বন্ধ্যা আমার মতোই? এগুলো কি আমার মতোই কোনো কিছু সৃজনে অপারগ?
হে মুহাম্মাদ! আমি শান্তি খুঁজছি...
হে মুহাম্মাদ! আমি শক্তি খুঁজছি...
হে মুহাম্মাদ! আমি শান্তি খুঁজছি...
উদ্গত এই বিশৃঙ্খল শব্দরাজি আপনার সম্মুখে পৌঁছার পথ কি পাবে, প্রিয় মুহাম্মাদ?
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
জ্বলন
মেঘের পাহাড়ে কার যেন জমে ব্যথা
নুনের শিশিরে জমে লোহে শুধু ঘুণ,
কাহার মানসে কার যেন পট আঁকা
হৃদয় উষাতে ভাঙে কার সব ভান।
এখানে ওখানে জ্বলে কাঁটা ফোঁটা ক্ষত
ওঁত পেতে বসে থাকা ঘামিয়ে নিষাদ,
চুয়ানো রক্ততে কারে লাগে কার মতো
সারারাত ঘুমে দেখা বাবার বিষাদ।
অহোরাত্র চেপে ধরা লৌকিক কান্নাতে
সুর তুলে তুলে হাসে অমোঘ দানব,
নদী, তাঁর পার ভাঙে যৌবন মৌতাতে
যেন কোনো অপস্মারে আক্রান্ত মানব।
করোটিতে কলবেতে জেগে থাকে সাপ
আমায় আটকে রাখে দোজখের পাপ।
----------------------------------------------------------------------------------------
প্রণম্য সোপানের পথ ধরে
যায়েদকে
............. ..................
আমরা দুইজন হাঁটতে থাকি,
ইট আর বালুর মিথ্যা রাস্তা পাড়ায়া পাড়ায়া, এইখান দিয়া আমাদের কথা হইতে থাকে, জুতা ঢুইকা যায় বালুর মাঝখান দিয়া দিয়া, পা বাইর করি, আবার কথা কই , ঘুইরা ফিইরা আহি একই জায়গায়, কথা অয়...
ও কয়, হ্যারিয়েট বিচার স্টোর কথা, আমি কই, এরিক মারিয়া রেমার্ক।
ও কয় গদ্যে শামসুল হক ঠাডায়া খাড়ায় রইছে, আমি মুখ ভেঙচায়া কই, আল মাহমুদের কবিতার লগে গদ্যটাও মিলা।
ও কয়, শাহাদুজ্জামান ভাল্লাগে, আমি কই, রাইসু ফাঁকে ফাঁকে ভালো চিন্তাও দেয়, ও কয় ,শাকুর মজিদ লিখতে জানে না, আমি কই, বদরুন নাহার পড়ছোস?
আমরা হাটি, সেলসম্যানগুলো এত্তো গাধা.... আমগোরে দেখলেই ইসলামের ইতিহাস আর বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারে সুফীগো কৃতিত্বের বই হাজির করে,
আমি কই ট্রান্সট্রোমারের লগে ওক্টাভিও পাজরে রাখলেন কই?
ওয় যেন ভোকচন্দর.......
লেখকরা তাকান, তাগো মধ্যে সাইয়েদ জামিল থাকে, দিব্য প্রকাশে বইসা থাকেন মইনুল আহসান সাবের, আহমাদ মাজহাররে দেখি, মাঝে দেইখা ফালাই আমগো মুসা আল হাফিজরেও।
বোরকাওয়ালি টিনএজাররা থাকেন, তাগোরে দেইখা আমরা ঘুইরা দাড়াই, পৃথিবীতে আরো কাম আছে, তাই ওগো লাইগা অতো ভাবনা নাই।
আমরা হাঁইটা-ই যায়, মাঝে মাঝে হাতে হাতে ওয় ঠোকাঠুকি, আমি হাত শিথিল রাখি, লাগলে লাগুক না, তবে ধরবার সাহস হয় না।
‘মিথুনের রাশিফল’ লেখক রায়হান রাইন করেন অনুবাদ, আত্তার কিংবা রুমি/তাবরিজের। আমরা হাইসা কুল পাই না।
ও কয়, জাকির তালুকদার ভাল্লাগে, আমি কই, স্যেকুলার রাজত্ব ভাঙলো তো পিনাকী, আমি কই, নাসরীন জাহান জোস, ও কয়, আনোয়ারা সৈয়দ হক পড়ছোস?
আমি কই, শহীদুল জহীরের গল্প চাখসোস? ও কয়, মান্নান সৈয়দ তারে অতো দাম দেয় নাইক্যা, আমি কই ,যতীন সরকার তো ভালো? ও কয়, সত্যেন সেন তো পড়া হইলো না।
ও কয়, মনিরুল মিরাজ চূর্ণায় সব নিয়ম কানুন, আমি কই, ইমতিয়াজ মাহমুদ শূন্যে খারায়া কি দেহায় দেখছোস?
জ্বলে সন্ধ্যাবাতি, আমরা হাঁটি, হাকিমে যাই, চপ খাই, তুহিন ভাইয়ের ট্যাকায়, বেচারা বড় ভাইসুলভ গাম্ভীর্যে অর্ধচপ মুখে দেয় না, অথচ পেডে তাঁর কতো ক্ষিদা, অইখানে দেখি আরো পোলাপাইন আহে, আমি কই, নেসার ভাইয়ের গদ্যটা দেখছস? ও কয়, এতো তৎসম, আমি কই, তুহিন মিয়াও জিনিস, ও কয়,হু হু।
আমি হাঁটি ,অয় হাঁটে ,ভাঙ্গে ওর খোলস, আমি হাঁটি, ওয় হাঁটে, লয়া যে যার কলস।
আমি হাঁটি, ওয় হাঁটে .........
আমি হাঁটি ,অয় হাঁটে
৩/১৯, ব্লক-বি, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা