এক।
মোগল অামল। স্থান ফররুখাবাদ। জায়গাটি বর্তমানে উত্তর প্রদেশের কানপুর বিভাগের একটি জেলা। কথিত অাছে যে, সেই সময়ের স্থানীয় মুসলিম শাসকের এক পুত্র নাম কাশিম অালী, ময়ুর শিকারের উদ্দেশ্যে ফররুখাবাদ গিয়েছিল। সে বন থেকে কিছু ময়ুর শিকারও করেছিল। সে সময় মালকানা হিন্দু রাজপুতদের একজন যার নাম ছিল ফতে সিং, কাশিম অালীকে হত্যা করে। মুসলিম শাসক পুত্র হত্যার প্রতিশোধ নিতে মালকানা রাজপুতদের সাথে যুদ্ধে জড়ায় এবং রাজপুতদের একজনকে বন্দি করে নিয়ে যায়, যার নাম ছিল উমরাও সিং। অনেকদিন বাদে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে উমরাও সিং মালকানায় ফিরে গেলে অন্য রাতপুতরা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। তাকে অচ্যূত ঘোষণা করে এবং নানা রকম নীপিড়ন ও নির্যাতন চালাতে থাকে।
অবশেষে উমরাও সিং ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নেয় এবং অামির খান নাম গ্রহণ করে। সেই থেকে মালকানা রাজপুতদের একটি অংশ মুসলিম হিসাবে অাগ্রা, দিল্লীসহ উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে মালকানা রাজপুতদের এই অংশটি মুসলিম হলেও তাদের পূর্বপুরুষদের যে ধর্ম তার অনেক কিছুই পালন করতো। কারো কারো বাড়ীতে রীতিমতো বিগ্রহও থাকতো। হিন্দু ধর্মের অনেক উৎসব যেমন তারা উদযাপন করতো অন্যদিকে নামাজও পড়তো, বিশেষ করে জুম্মা ও ঈদের নামাজ। তারা নাম হিসাবে মুসলিম নাম গ্রহণ করতো এবং হিন্দু ধর্মের অনেক অনুশাসন মেনেও চললেও মৃতদেরকে তারা কবর দিত। সেই ধারা এখনও চলে অাসছে।
এহেনও মালকানা মুসিলম রাজপুতরা দলে দলে হিন্দু ধর্মে ফিরে যেতে শুরু করে ১৯২৩ সাল থেকে। ১৯২৮ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটি ১৬৩০০০ দাঁড়ায় (সূত্র: "Hindu-Muslim Relations: a study of controversy; conflict and communal movements in Northern India 1923 to 1928" by Gene R. Thusby)। এবং হিন্দু সভার হিসাবে সংখ্যাটি ৩৫০০০ এর মতো। এই ঘটনার নেতৃত্বে যািনি ছিলেন তাঁর নাম স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শাস্ত্রী। তাঁর পৈত্রিক নাম মুনশি রাম ভিজ। তিনি উত্তর ভারতের অার্য সমাজের নেতা ছিলেন এবং গুরুকুল কাঙারী নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯১৫ সালে গান্ধী দক্ষিণ অাফ্রিকা থেকে ফিরে পন্ডিত মদন মোহন মালভিয়াকে সাথে নিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন এবং ঐ স্কুলে রাত্রি যাপন করেন। গান্ধী, তাঁকে মহাত্মা নামে সম্বোধন করেন, তিনিও গান্ধীকে মহাত্মা নামে সম্বোধন করেন। সেই থেকে গান্ধীর নামের অাগে মহাত্মা কথাটি ব্যবহার শুরু হয়। অার তিনি ১৯১৭ সালে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ শাস্ত্রী নাম গ্রহণ করেন এবং দয়ানন্দ স্বামীর উত্তরসূরী হিসাবে অার্য সমাজের সকল কর্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। তিনি অবশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামে কংগ্রসের পক্ষে কাজও শুরু করেন এবং ১৯১৯ সালের ৩০ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের পর অমৃতসর কংগ্রসে অধিবেশনে সভাপতিত্বও করেন।
Rowlatt Act এর প্রতিবাদে যে সত্যাগ্রহ অান্দোলন শুরু হয়েছিল সেই অান্দোলনে দিল্লীর মুসলিমদের অনেকে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়। সেই ঘটনায় স্বামী শ্রদ্ধানন্দ মুসলিমদের প্রতি সহানুভূতি জানান এবং তিনিই কোন প্রথম হিন্দু নেতা যিনি প্রথম দিল্লীর জামে মসজিদে জুম্মার নামাজের পর সমেবেত মুসল্লিদের উদ্দেশ্য বক্তব্য রাখেন সেই ১৯১৯ সালেই। সেই তিনিই ১৯২০ সালে হিন্দু সভায় যোগ দেন এবং ১৯২৩ সালে 'শুদ্ধি অান্দোলনে'র গোড়াপত্তন করেন এবং সভাপতি হিসাবে কাজ শুরু করেন। শুদ্ধি অান্দোলনের মুল কথা ছিল যারা বিভিন্ন কারণে হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে চলে গেছে তাদেরকে পূনরায় হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে অানা, বিশেষত ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্ম থেকে। তিনিই মালকানা রাজপুতদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে অানেন। এমন কি গান্ধীর বড় ছেলে হীরালাল মুসলমান হবার পর গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরী দেবীর অনুরোধে গান্ধী স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে একই অনুরোধ করেন এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দ হীরালালকে হিন্দু ধর্মে ফিরে যান।
স্বাভাবিকভাবেই স্বামী শ্রদ্ধানন্দ মুসলিমদের অন্যতম প্রধান শত্রুতে পরিণত হন এবং পরিণামে ১৯২৬ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর দিল্লীতে নিজের বাড়ী অাব্দুর রশিদ নামের এক উগ্র মুসলিমের হাতে মারা যান। সে ঘটনা ও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া এবং বাঙালী তিন সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের অবস্থান নিয়ে পরের লেখায় অালোচনা করবো।
চলবে...
৩/১৯, ব্লক-বি, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা