হাওরে স্বপ্ন ডুবছে

স্টাফ রিপোর্টার, দুরবিন ডটকম

হাওরে ডুবছে সব, মানুষ, ধান, পশু-পাখি, স্বপ্ন-আশা, ভালোবাসা। কিন্তু দেখার কেউ নেই। কেউ জানছেও না। আর যারা জানছেন, তাদেরও মাথা ব্যথা নেই।

কারুর-ই কি নেই। আমরা তা-ই দেখেছিলাম। আমাদের সাথে যারা কথা বলেছেন, তাদের আলাপটা এখানে, 

রাফিয়া তামান্না

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

" বর্ষায় নাও, শুকনায় পাও, এইডাই উজান-বাডির বাও" বহুল প্রচলিত উক্তিটি যেই সম্ভাবনাময় হাওর এলাকাকে নিয়ে, সেই হাওর এলাকার সাধারণ মানুষের দুর্দশার চিত্র দেখেই শুরু হয় নতুন আরেকটি বাংলা বছর। উজানের পানির ঢল নেমে ও অতিবৃষ্টির কারণে নেমে আসা দুর্যোগ ছাড়াও এই অঞ্চল যেনো সবসময়ই থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে। এতো বড় বিপর্যয়ের সময়ও সম্মিলিত পদক্ষেপের বদলে আমরা দেখতে পাই নানা দলের লোকেদের একে অন্যকে দোষারোপ। এই সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু আকস্মিক বন্যার পরবর্তী সময়ে গৃহীত পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। উপযুক্ত জায়গায় বাঁধ দেওয়া, এবং এর নির্মাণ কাজ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে উপযুক্ত লোক নিয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আগাম বন্যার কারণে হঠাৎ করেই এতো বড় ক্ষতি এড়াতে সারা বছর জুড়েই এ নিয়ে পরিকল্পনা করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সেইসাথে প্রয়োজন, সম্ভাবনাময় এসব এলাকার কৃষকদের চাষাবাদ পদ্ধতিতে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান, এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সম্ভাবনাগুলোকে যাতে হাওরবাসীরা কাজে লাগাতে পারে সে সম্পর্কিত শিক্ষা প্রদান।

 

শাহ্ নাওয়াজ শিমুল

জামিয়া আহসানুল উলুম আদাবর

আমরা সবাই জানি যে, প্রায় প্রতিবছর সুনামগঞ্জে বন্যা হয়। আর এই বন্যার কারণও আমাদের সবার জানা। সাধারণত প্রবল বর্ষা অথবা হাওরের বাঁধ ভেঙে ওপাড়ের পানিতেই বন্যা হয়।

এবার বৈশাখের শুরুতেই প্রবল বর্ষা শুরু হয়। সেই বর্ষা আর মেঘালয় পাহাড়ের ঝর্ণার পানির চাপে হাওরের অস্থায়ী বাঁধ ভেঙে এই বন্যার সৃষ্টি। অসময়ে বন্যা প্রতিরোধে জন্য হাওরের বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বাঁধটাকে চাইলেই অতি মজবুত করে করা যায় তবে এতে করে হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জলজ প্রাণ-পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে কারনেই হাওরের বাঁধ সাধারণ হয়। এই বাঁধের মেয়াদ এপ্রিলের ৩০ তারিখ পর্যন্ত। ত্রিশ তারিখের পর বৃষ্টি, বন্যা, প্লাবণে হাওর ভেসে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে এ ক্ষেত্রে কেন এমন কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়না যেটাতে বাঁধ মজবুত হবে এবং হাওরের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জলজ প্রাণ-পরিবেশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেনা। এটা আসলেই আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা এ ধরণের কোন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারি নাই। আপনি চাইলে এটাকে সরকারের গাফিলতি বলতে পারেন।  হাওর এলাকার মানুষ সাধারনত মাছ চাষ ও ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের কেউ কেউ অবশ্য পশু পালনও করে থাকেন। ঠিক এই কারণেই বন্যায় তাদের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হয়। কারণ বন্যায় ফসল ডুবে নষ্ট হয়, মাছ ভেসে যায় এবং পশু মরে যায় । এতে করে তারা চরম বিপদে পড়েন।

তবে এবারের বন্যার সমস্যা একটু ভিন্ন। অন্যবারের তুলনায় এতে ক্ষয়ক্ষতিও অনেকাংশে বেশি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের বিভিন্ন স্থানে কয়লা খনিতে ইউরেনিয়াম (পরমাণু বোমা বা বিদ্যুৎ তৈরিতে ব্যবহৃত রাসায়ানিক পদার্থ) ব্যবহার করার পর তা অরক্ষিত রেখে কয়লা খনি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে। এসব পরিত্যক্ত খনি থেকে পাহাড়ি ঢলের সাথে ইউরেনিয়াম ভাটির এলাকায় এসে প্রাণ-প্রকৃতির মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। যার কারনে এই বন্যায় প্রচুর জলজ প্রাণী মরে যাচ্ছে । তবে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে পানিতে কোন ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়নি। তবে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ০.০১ থেকে ১.১৫ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) দেখতে পান, যা স্বাভাবিক মাত্রার (৫ থেকে ৮ পিপিএম) চেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে কম। একই সঙ্গে অ্যামোনিয়ার পরিমাণও ছিল মাত্র ০.০৪ থেকে ০.০৮ পিপিএম, যা অস্বাভাবিক। অ্যামোনিয়ার লিথাল মাত্রা পাওয়া গেছে ০.২ পিপিএম। গ্যাসের বিষক্রিয়া ও অক্সিজেনের সংকটে হাওর এলাকায় মাছে মড়ক দেখা দিয়েছে।

 যাই হোক, এই বন্যার কারণে এলাকার মানুষ সামনের দিনে চরম দুর্ভিক্ষে পতিত হবে এটাতে কোন সন্দেহ নাই। এই বন্যায় মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমান স্থানীয় হিসাবে ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। ভাবুন একটু, সামনের সময়ে  জন্য কি ভয়ানক অবস্থা অপেক্ষা করছে। শুধুমাত্র এটা ঐ এলাকার ক্ষতি নয় সমগ্র দেশের ক্ষতি। তাই সচেতন নাগরিক হিসেবে আপনার আমার দায়িত্ব হল সরকারের উপরে চাপ তৈরি করে এমন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা যাতে হাওরের বাঁধ মজবুত হয় আবার হাওরের পরিবেশও নষ্ট না হয়, এবং অবিলম্বে সুনামগঞ্জে আটকে পড়া মানুষের জন্য দ্রুত ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মসূচি গ্রহন করতে সরকারকে অনুরোধ করা। যেহেতু প্রশাসন এখনো ত্রাণ ও উদ্ধার কর্মসূচি গ্রহন করেনি সেহেতু আমরা এটাকে প্রশাসনের গাফলতি বলতেই পারি ।

 

শেখ কান্তা রেজা

ইনস্টিটিউট অফ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এন্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলাজুড়ে বিস্তীর্ণ হাকালুকি হাওর, টলটলে হাওরের পানিতে জ্যোৎস্না রাতে ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন থাকতো অনেক ভ্রমণপিয়াসুদের। হাওর শুধু সৌন্দর্যের সমৃদ্ধি নয়, মৎসভান্ডার হিসেবেও পরিচিত ছিল। "ছিল" - তার কারণ এই হাওর এখন সুনামগঞ্জের মানুষের কাছে একটা বিভীষিকা! আগাম বন্যায় তলিয়ে গেছে সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওরের বোরো ফসল, তার কয়েক দিন পর থেকে হাওরের পানিতে মাছ , হাঁস ও কীটপতঙ্গ ভেসে উঠতে শুরু করেছে। মিডিয়াতে গত কয়েকদিন ধরে আলোচ্য বিষয় হাওর। ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া কোন নতুন ঘটনা নয়, দক্ষিণাঞ্চলে মাঝে মাঝেই বন্যায় ধান চলে যায় পানির নিচে। কিন্তু তার প্রভাবে সবসময়ই দেখা গেছে মাছের বৃদ্ধি,  জলাবদ্ধ ধানক্ষেত হয়ে উঠতো মাছের মেলা।  কিন্তু সুনামগঞ্জের হাওরের জমে থাকা পানিতে ভেসে উঠছে মরা মাছ, এমনকি হাঁসেরও মৃত্যু হচ্ছে সেই বিষাক্ত পানির কারণে।  সঠিক গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ এর অভাবে একদল অসাধু মানুষ মৃত মাছগুলো ধরে ব্যবসাও শুরু করেছে! একদল বলছে মাছ মরে যাওয়া, একটি পরিকল্পিত ঘটনা, অন্যদল বলছে বিষাক্ততার কারণে হচ্ছে এসব - দ্বিধান্বিত হচ্ছে এলাকার মানুষ, কষ্টের মাত্রা বাড়ছে দিন দিন। কৃষকদের না আছে ধান, না আছে মাছের উৎস। তাদের মলিন মুখগুলো শুধু সাহায্য চাইছে, চাইছে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে। ত্রাণ দিয়ে তাদের পেট ভরানো গেলেও সান্ত্বনা দেওয়া যাচ্ছে না তাদের কোনমতেই, একটু একটু করে ফলানো ধানের এভাবে তলিয়ে পঁচে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না হাওরবাসী।  অন্যদিকে নোংরা বাণিজ্যে মেতে উঠছে অসাধু লোকজন, মিডিয়ার কাটতি হয়ে উঠেছে কৃষকদের করুণ মুখ!  এ সমস্যার সমাধান চাই।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫ ঘন্টা/২৬এপ্রিল, ২০১৭/এইচএএম/দুরবিন ডটকম


সম্পাদক: আবু মুস্তাফিজ

৩/১৯, ব্লক-বি, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা