বিপুল জামান
“কোনোদিনও আসেনি প্রেম কাছে
চারিদিকে শুধু অবহেলা
শ্যাওলা কাঁদায় ভরে গেছে
এ মনের স্বপ্ন ভেলা
হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা
কিছু ভালোবাসা দাও”
তখন ক্লাস থ্রি কি ফোরে পড়ি। ভালোবাসা কী জানতাম না। কিন্তু খারাপ লাগতো ঐ ছেলেটার জন্য যে চিৎকার করে বলছে "কিছু ভালোবাসা দাও" সেই খারাপ লাগা আরো ঘন হয়ে ওঠে যখন প্রায় ম্রিয়মাণ কন্ঠে কেউ বলে, “কোনোদিনও আসেনি কেউ কাছে, চারিদিকে শুধু অবহেলা”। আমার খারাপ লাগতো। সত্যি খারাপ লাগতো। গানের কথাগুলো তখন বুঝতাম না। সুরেই বুঝতাম চিৎকার করে গাওয়া এই গানের ভেতর খুব মন খারাপ করা একটা ব্যাপার আছে। সেই থেকে ওই দুঃখবোধ আমার মনে সিল করা হয়ে গেল। আজ পর্যন্ত বলেই চলেছি "কিছু ভালোবাসা দাও, কিছু ভালোবাসা দাও"।
আজ বুঝি সুর এই খুনে কাজটা করেছে। আমি তখনও জানি না গানটার সুর কে করেছেন। নাম জানি না লাকী আখন্দের। চমৎকার কথার গান, চমৎকার কন্ঠে তুলে দেওয়ার সমন্বয় কে করেন আমি জানি না। এই গান চিনলাম হাসানের গান নামে। লাকী আখন্দ সবসময় পেছনেই ছিলেন তাকে জানতে আমার অনেক দেরি হয়েছে।
অবহেলার গান শুনে অবহেলাই দেখতে পেতাম চারিদিক। পর বুঝলাম এর নাম দুঃখ বিলাস। তখন ফিতে ক্যাসেটের যুগ। বড় মামার মেঝো ছেলে, মেঝো ভাইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। বাড়ির একপাশে তার ঘর। অনু্চ্চ স্বরে তার ঘরে গান বাজে। তিনি পড়েন। ব্যায়াম করেন। বন্ধুবান্ধব আসে। ক্লাবের কাজের কথা হয। সাথে গান বাজে অমি রুমের আশাপাশে ঘরাঘুরি করি। গান শুনি।
বই পড়া ধরেছি কেবল। শ্রীকান্ত। তাই খেলতে যাই না। শ্রীকান্তের বোহেমিয়ান জীবন ভালো লাগে। মনে আশা, আমিও বার্মা যাব। ফেরার হবো। মেঝো ভাইয়ের শোনা গান আমাকে এমন মোহাবিষ্ট করেছিল। ফেরারী পখিরা কুলায় ফেরে না। আমায় ডেকো না। এই ঘোর নিয়েই পঞ্চম শ্রেনীর বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ঘর ছেড়ে পালাই। বেনাপোলে সাড়ে তিনদিন থাকি। বর্ডার পার হবো। ভারত যাবো। সে কয়দিন খুব গেয়েছিলাম আমায় ডেকো না। ফেরানো যাবে না। না, কেউ ডাকেনি। বেঁধে এনেছিল।
গান ভালোবাসে, এমন বলয়ে ছিলাম না। খুব বেশি গান শোনা তাই হয়নি। স্কুলের পিকনিকগুলোতে সবাই গাইতো, চলো না ঘুরে আসি অজানাতে। গানটা শুনতে শুনতে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাল দিতে পারতাম। তখনো জানি না গানটার ইতিহাস। কয়েক বছর আগে চলচ্চিত্র বিষয়ের এক সেমিনারে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি, তাঁর প্রথম ছবি ঘুড্ডি নিয়ে কথা বলছিলেন। তখন এই গানটির কথা বললেন। বললেন, লাকি আখন্দের কথা। তার ভাই হ্যাপী আখন্দের কথা। হ্যাপী আখন্দের অকাল প্রয়াণের কথা। প্রয়াত লাকী আখন্দের সংগীত চর্চায় বিরতি পড়বার কথা। তিনি ছিলেন তাদের বন্ধু। সহজেই লাকি আখন্দ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন আমাদের।
তার আগে ও পরে বারবার বহুবার শুনেছি তার সংগীতায়োজনে গান, ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না’, ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে’। কৈশোরের শেষ ধাপে যৌবনের প্রারম্ভের অসহ্য রাতগুলোর সান্ত্বনা ছিল, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘আগে যদি জানতাম, তবে মন ফিরে চাইতাম’ গানগুলো।
না , ডাকবো না এই মনন দরিদ্রতার মাঝে। ফেরারী পাখি তুমি ফিরে গেছ কুলায়। শুধু স্বদেশের দুর্দশায় তোমায় ডাকবো গাইতে,
“হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ
আলোর কিছু থাকছে রেশ, এতেই ভালো লাগছে বেশ”।
এই অনুপ্রেণার জন্যই বারবার ডাকবো হে কিংবদন্তী। নইলে কে গাইবে এই গান? ভেতরে আলো না থাকলে কি আলোর গান গাওয়া যায়? আমাদের আপনি ছাড়া কেই বা অমনভাবে বলতে পারবে, ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ, চারিদিকে বাংলাদেশ’।
কিংবদন্তী সুরে সুরে আপনি কিছু ভালোবাসা চেয়েছিলেন, আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসা।
সুরকার কী না, নিভৃতে আঙুলের ইশারায় হৃদয়তন্ত্রীতে অনুরণন তুলতে সিদ্ধহস্ত তিনি। গানের কথা লেখা বা গাওয়াতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দী।
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। শিল্পী বা অন্যদের সাহায্যে অনীহা ছিল তার। রাষ্ট্র মাত্র ৫ লাখ টাকা অর্থ সাহায্য করেছিল। টাকার অভাবেই নাকি শেষবার ব্যাংকক যাননি চিকিৎসা করাতে।
অভিমান, আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না।
হৃদয়ের নীল মণিহার হয়ে থাকবেন লাকি।
৩/১৯, ব্লক-বি, হুমায়ুন রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা